নিষিদ্ধ দর্পণ - তনুশ্রী গাঙ্গুলি,Banned Darpan - Tanushree Ganguly

 

নিষিদ্ধ দর্পণ


তনুশ্রী গাঙ্গুলি


নিষিদ্ধ দর্পণ

তনুশ্রী গাঙ্গুলি

Wall Magazine -এখানে ক্লিক করুন   -আরও পড়ুন



পুরনো বাড়িগুলো কেবল ইট-পাথর নয় — তাদের দেওয়ালের ভেতর লুকিয়ে থাকে মানুষের অনুচ্চারিত স্মৃতি, নিঃশব্দ ভালোবাসা, অজানা ভয়; বাড়ির আসবাবগুলিও সেই রহস্যময়তা থেকে মুক্তি পায় না। কলকাতার উত্তর প্রান্তে তেমনই এক পুরোনো দ্বিতল বাড়ি। দেওয়ালের প্লাস্টার খসে পড়েছে, কাঠের জানালায় ঘুণের গন্ধ। কলকাতা শহরের কোলাহলের মাঝেও এখানে যে একরকম থেমে থাকা সময়ের গুঞ্জন শোনা যায় তা এখানে না আসা মানুষের বিশ্বাস করা বেশ অসম্ভব।


    এই বাড়ির দ্বিতীয়তলায় ছোটো একটা ঘর ভাড়া নিয়েছেন ঋতব্রত রায় — বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ গবেষক। বিষয়: “বাংলা সাহিত্যে অলৌকিক বাস্তবতার মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা।” তিনি সাহিত্যে যুক্তি খোঁজেন। তার বিশ্বাস — অলৌকিক বলে কিছু নেই, মানুষের ভিতরের গভীর ভয় আর স্মৃতিই নানা রূপে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ দূরে হলেও তার কাছে বাড়িটা নেহাত মন্দ নয়, বরং বেশ কাজের, কয়েকটি সুবিধাও রয়েছে। এখানে এসেই শুনেছেন, একসময় এখানে থাকতেন এক কবি, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনকভাবে। ফলে গবেষণার রসদের অভাব হবে না, অন্যদিকে বাড়িটি নিয়ে এসব প্রচলিত থাকায় কেও তেমন ঘেঁষে না - ফলে নিজের মতো গবেষণার সময় ও সুযোগ পাবেন। এছাড়া বাড়িওয়ালা অন্য বাড়িতে থাকেন, প্রতিদিন সকালে একবার করে বাড়িটি দেখতে আসেন শুধু। যিনি বাড়িটি দেখাশোনা করেন ও ভাড়াটেকে খাবার দেবেন তিনি অস্বাভাবিক রকমের শান্ত। নিজের মনেই কাজ করেন , সন্ধ্যার পূর্বে রাতের খাবার দিয়ে চলে যাবেন নিজের বাড়িতে। ফলে বাড়িটি ভাড়া নিতে দুবার ভাবেন নি তিনি।


      ঘরটিতে ঢোকার দিনই ঋতব্রতবাবু লক্ষ্য করলেন, দেয়ালের কোণে বেশ বড়ো একটি প্রাচীন দর্পণ, ছোট ঘরে এত বড়ো দর্পণ স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সাথে দেখতেও অন্য দর্পণের থেকে ভিন্ন। কালচে রূপালি প্রলেপে ঢাকা; ফ্রেমটা কাঠের, তাতে খোদাই করা অদ্ভুত লিপি — যেন আরবি বা সংস্কৃতের মিশ্রন, কিন্তু পুরোপুরি কোনোটাই নয়। দর্পণের পিঠে কালচে দাগ, তবে মাঝখানে এক টুকরো অংশ অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল।


        বাড়িওয়ালা, বৃদ্ধ গোপালচন্দ্রবাবু, হালকা গলায় বলেছিলেন, “ও আয়নাটা আপনি নাড়াচাড়া করবেন না বাবু। আগের ভাড়াটে একদিন তাকিয়ে ছিলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পরে দেখি ঘর ফাঁকা, মানুষ উধাও। আপনি রাখুন, কিন্তু রাতে পর্দা টেনে রাখবেন।”


ঋতব্রতবাবু হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন, “ভূত-টুত মানি না আমি কাকা।” এই উত্তরে লোকটির উদাসীন হাসি ও ম্লান চেহারা দেখে ঋতব্রতবাবুর লোকটিকে অসুস্থ বলে মনে হয়েছিল।



      রাত বাড়ে। আকাশে মেঘ জমে। টেবিল ল্যাম্পের নরম আলোয় ঋতব্রতবাবু লিখছেন। কিন্তু প্রথম রাতেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটে। রাত আড়াইটে নাগাদ টেবিলের কাগজে হালকা বাতাস লাগে, ঠিক তখনই একটা হালকা শব্দ—টুপ, টুপ। জানলার কাচে শিশির নয়, যেন কেউ আঙুল দিয়ে ঠুকছে। ঋতব্রতবাবু ফিরে জানালার দিকে দেখতে যাবেন হঠাৎ চোখ পড়লো জানালার পাশের দর্পণটিতে। দর্পণের ভিতর থেকে এক অস্পষ্ট নারীমুখ তাকিয়ে আছে, অথচ চোখদুটো অস্বাভাবিক স্পষ্ট; সেই অস্পষ্ট মুখেও অদ্ভুত প্রশান্তি, অথচ চোখদুটো যেন হাজার বছরের অপেক্ষা নিয়ে তাকিয়ে, সাথে দীর্ঘশ্বাসের আভা। কিছু পরেই মিলিয়ে গেলো। ঋতব্রতবাবু সামান্য চমকে উঠলেও ক্লান্তির কারণে মনের ভুল ভেবে সেদিনের মতো গবেষণার কাজ রেখে দিলেন, তারপর আলো নেভাতে গিয়েও কি ভেবে আলো জ্বেলেই ঘুমিয়ে গেলেন। মাঝে বেশ কিছু শব্দ কানে এলেও, সারাদিনের যাতায়াতের ক্লান্তির পর গভীর ঘুমের কাছে তা বিশেষ পাত্তা পায়নি।



        পরদিন সকালে সব স্বাভাবিক। আয়নাটা নিস্তব্ধ, কাচে নিজেরই মুখ দেখা যায়। ঋতব্রতবাবুর রাতের কথা মনে আসতেই হেসে ওঠে ভাবেন, যাতায়াতের ক্লান্তি, গবেষণার চাপ, অতিপ্রাকৃত গল্প, সাথে গোপালচন্দ্রবাবুর অস্বাভাবিক কথা সব মিলিয়ে তিনিই না অসুস্থ হয়ে যান। গবেষণার কাজ শেষ হলে বড়ো একটা ছুটি নিবেন এসব থেকে।



      কিন্তু রাতে আবার একই দৃশ্য। এবার আয়নার ভেতরের নারীর মুখ আরেকটু স্পষ্ট। এভাবেই চলতে থাকে রাতগুলি। ঋতব্রতবাবু দিনের বেলায় আলাদা মানুষ, রাতের সবকিছু স্বপ্ন বলে মনে হয়, বাড়িটি ছেড়ে অন্য বাড়ি ভাড়া নেবেন ভাবেন; কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে পারেন না। আবার রাতে দর্পণের নারীটিকে সবচেয়ে বাস্তব বলে মনে হয়।

হঠাৎ একদিন রাতে দেখেন অস্পষ্ট নারীটি সম্পূর্ণ স্পষ্ট, শুধু তাই নয়, নারীকণ্ঠ বলে উঠলো,

“তুমি লেখো না কেবল আমার কথা? আমি ছিলাম এই ঘরে। আমার নাম ছিল চিত্রাঙ্গী।”

ঋতব্রতবাবু চমকে বলে ওঠেন, “কে! কে তুমি?”

মৃদু হাসিতে মিলিয়ে যেতে যেতে আওয়াজ আসে, “ভূত নয়, স্মৃতি।”


       দিনে দিনে ঋতব্রত বাবুর প্রবন্ধের বিষয় বদলাতে থাকে। এখন তিনি লিখছেন—‘স্মৃতি ও দর্পণের অন্তর্জগৎ’। প্রতিরাতে চিত্রাঙ্গী তাকে গল্প শোনায়—এক কবির, যিনি নিজের হৃদয়ের দর্পণের ভিতরে নিজের প্রতিচ্ছবিতে প্রেম খুঁজেছিলেন, আর শেষমেষ তাতে বিলীন হয়েছিলেন। ঋতব্রতবাবু বুঝতে পারেন না, তিনি গবেষক নাকি সেই কবির উত্তরসূরি। ধীরে ধীরে তিনি অনুভব করেন, তার নিজের চিন্তা ও শব্দ যেন ওই নারীর হাতেই বোনা হচ্ছে। তার কাছে দর্পণ ও লেখার খাতা বাদে পুরো পৃথিবীটাই যেন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে রাতের বেলা। সাথে ঘরের বাইরে যেন প্রচণ্ড ঝড়ের আওয়াজ পান প্রতিদিন। 

       তবে যেদিনই বিশ্ববিদ্যালয় যান সকলের তার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকানো দেখে অবাক হন। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আরেক গবেষক বন্ধু প্রতাপবাবু বলেন, “তুমি কেমন  দিন দিন ম্লান হয়ে যাচ্ছ ঋতব্রত! চেহারায় রক্ত নেই। যদি ভাড়া বাড়িতে সমস্যা হয় আমার বাড়িতে চলে এসো।”

ঋতব্রতবাবু কেবল উদাসীন হাসি হাসেন। ভাবেন, রাতগুলো যে এখন তার অন্যরকম। তিনি যে কিছু আবিষ্কার করছেন, তা শেষ না করলে বোধহয় তার মুক্তি নেই, মুক্তি কি আদেও চান তিনি। এখন আর এতো ভাবতে পারেন না তিনি, শুধু অপেক্ষা করেন রাতের, ঝড়টা এখন যেন আর বাইরে হয় না, তার অন্তর থেকেই সেই আওয়াজ পান, যেটা তাকে কোথাও একটা নিয়ে যেতে চায় - কিন্তু কোথায় তা জানা নেই ঋতব্রত বাবুর।

      একদিন রাতে হালকা বৃষ্টি, হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। ঋতব্রতবাবু অন্ধকারে ঘরে একা বসে আছেন, অস্বস্তি বোধ হওয়াতে মোমবাতি খুঁজতে গিয়ে দেখেন অন্ধকারে আয়নাটা নিজেই জ্বলজ্বল করছে, সাথে আয়নার মাঝে কত কিছু ছবি ফুটে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ভিতরে দেখা যায় এক পুরনো প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ, ভেতরে মৃদু সুর—“যে শব্দে তুমি আমায় ডাকো, সেই শব্দেই আমি জেগে উঠি।” তারপর দেখা যায় সেই পরিচিত নারীমুখ, দর্পণের ভিতর থেকে চিত্রাঙ্গী বলে ওঠে, "এই দর্পণে বন্দী আমি, কারণ আমার কবি আমাকে অসম্পূর্ণ রেখেছিল। তুমি যদি লিখে শেষ করো, আমি মুক্তি পাব, তুমিও হবে মুক্ত।"

ঋতব্রতবাবু লিখতে বসেন। তার কলম থামে না—রাত পেরিয়ে যায়। শেষ লাইন লিখে ফেলার পর চিত্রাঙ্গীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে, বলে—“এসো, এবার দু’জনেই সম্পূর্ণ হই।” হাত বাড়িয়ে বলে, “এবার এসো। এ দিকেই মুক্তি, এদিকেই আলো।”

ঋতব্রতবাবু তাকিয়ে থাকেন। তার মুখে কোন দ্বিধা নেই, নেই কোনো ভীতি। এগিয়ে যান সামনের দিকে, আঙুল ছোঁয় আয়নায় - কাচটা উষ্ণ, যেন জীবন্ত চামড়া।চোখে এক ঝলক আলো পড়ে, তারপর নিস্তব্ধতা।

      পরদিন সকালে গোপালচন্দ্রবাবু দরজার বাইরে এসে দেখেন, ঘর খোলা। ভেতরে কেউ নেই। টেবিলে একটাই জিনিস—একটা পাণ্ডুলিপি।

শিরোনাম লেখা— “নিষিদ্ধ দর্পণ”

বাকি লেখা বোঝা যায় না, শুধু বোঝা যায় শেষ দুটি লাইন: "মানুষ যে দর্পণে নিজের মুখ দেখে, সেখানেই একদিন তার আত্মা প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে, ক্ষুধার্ত দর্পণ তখন তাকে গ্রাস করে। এই দর্পণ কখনও ভাঙে না, সে শুধু অপেক্ষা করে—আরেক মুখের, আরেক জীবনের জন্য।”

     গোপালচন্দ্রবাবু দর্পণটা ঢেকে দিয়ে নিঃশব্দে ঘরটা বন্ধ করে দেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির বাইরে টাঙিয়ে দেন - "বাড়িটি ভাড়ার জন্য উন্মুক্ত। আগ্রহী ব্যক্তি যোগাযোগ করুন।"

Comments