“The Temptation of Karna from the Udyog Parva” অংশটির বাংলা অনুবাদ ও ব্যাখ্যা
4.3.1 কৃষ্ণের সঙ্গে কর্ণের সংলাপ
কর্ণকে রথে উঠতে অনুরোধ করার পর, কৃষ্ণ ধীরে ধীরে কর্ণের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য প্রকাশ করতে শুরু করেন। তিনি শাস্ত্র অনুসরণ করে বলেন যে, বিবাহের আগেই কোনো নারীর গর্ভে যে পুত্র জন্ম নেয়, সে বৈধ সন্তান হিসেবে নিজের অধিকার দাবী করতে পারে। কৃষ্ণ বলেন—
"তুমি কর্ণ, সেইরকম জন্মেছ। আইন অনুসারে তুমি পাণ্ডুর সন্তান।"
উদ্যোগ পর্বে কর্ণকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা:
"আইনের বিধান অনুযায়ী তুমি পাণ্ডুর পুত্র, সুতরাং আমার সঙ্গে চলো, তুমি রাজা হবে।"
এই সময় কর্ণের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা আসে। সারাজীবন তিনি ক্ষত্রিয় পরিচয়ের জন্য অপেক্ষা করেছেন। এখন সেই পরিচয় ও রাজত্বের সুযোগ একসঙ্গে তাঁর সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। কৃষ্ণ তাঁকে মুগ্ধ করার জন্য ভবিষ্যতের রাজত্বের এক চমৎকার চিত্র তুলে ধরেন—
"পাঁচ পাণ্ডব তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়বে ভাই হিসেবে, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র ও অভিমন্যুও তাই করবে।"
কৃষ্ণ জানেন, কর্ণের একান্ত ইচ্ছা হলো পাণ্ডবদের পায়ের নিচে দেখতে চাওয়া, এবং নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। এরপর কৃষ্ণ সম্পদের প্রাচুর্য ও ভোগ-বিলাসের দৃশ্য তুলে ধরেন—
"রাজকন্যা ও বনিকজাত নারীসকল সোনা, রুপো ও মাটির পাত্রে ভেষজ, বীজ, রত্ন ও গুল্ম নিয়ে আসবে তোমার কল্পনার জন্য। ষষ্ঠ দিনে তুমি দ্রৌপদীর সঙ্গে মিলিত হবে।"
এইসব প্রলোভনের মাধ্যমে কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর সোজা নীতিগত অবস্থান থেকে সরাতে চান। কর্ণ যেহেতু ব্রাহ্মণদের স্বীকৃতি কখনোই পাননি এবং সর্বদা সুতপুত্র হিসেবে তাচ্ছিল্য ভোগ করেছেন, কৃষ্ণ সেই অপমানবোধকে উস্কে দেন। তিনি বলেন—
"আজ চার বেদের প্রতিনিধিত্বকারী ব্রাহ্মণরা তোমাকে রাজ্যাভিষেক করবেন, পাণ্ডবদের পুরোহিত তোমার পাশে থাকবে, তুমি বাঘছাল পরিহিত অবস্থায় বসে থাকবে।"
আরও একটি কৌশল হিসেবে কৃষ্ণ কর্ণের অর্জুন-বিদ্বেষকে উসকে দেন—
"অর্জুন তোমার রথ চালাবে, তার শুভ্র ঘোড়ায় টানা রথে।"
4.3.2 কর্ণের উত্তর কৃষ্ণকে
কৃষ্ণের সব প্রস্তাব শুনে কর্ণ একটি গভীর ও আবেগপূর্ণ উত্তর দেন। তিনি বলেন—
"হ্যাঁ কৃষ্ণ, আইনের দৃষ্টিতে আমি পাণ্ডুর সন্তান, কিন্তু কুন্তী আমাকে এমনভাবে ফেলে দিয়েছিলেন যেন আমি মৃত সন্তান।"
এখানে কর্ণের জন্মসংক্রান্ত দুঃখ গভীরভাবে প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, অধিরথ তাঁকে ভালোবেসে ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং রাধা মা হিসাবে তাঁকে বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলেন—
"রাধার স্তনের দুধ ভালোবাসা থেকে নিজে থেকেই গড়িয়ে পড়েছিল, তিনি আমার মল-মূত্র পরিষ্কার করেছেন, কৃষ্ণ! আমি কীভাবে তাঁকে পিতৃপুরুষের তর্পণ অস্বীকার করব?"
এই দায়বদ্ধতা থেকে কর্ণ সরে আসতে পারেন না। এখানে দুটি মাতৃত্বের চিত্র তুলে ধরা হয়—
• কুন্তী: যিনি তাঁকে ত্যাগ করেন
• রাধা: যিনি তাঁকে মমতায় গ্রহণ করেন
কর্ণ বলেন—
"অধিরথ আমাকে নিজের ছেলে ভাবেন, আমার ভালোবাসাও তাঁকে পিতা হিসেবে মান্য করে।"
তিনি বুঝিয়ে দেন যে, সামাজিক পরিচয় বদলানো যায় না, কারণ তাঁর জীবন ও ভালোবাসার বন্ধন সুত সম্প্রদায়ের সঙ্গে গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন—
"আমার জন্মস্মারক ক্রিয়াকর্ম ব্রাহ্মণদের দিয়ে করানো হয়েছিল, অধিরথের ভালোবাসা থেকে। তিনি আমাকে নাম দিয়েছিলেন বসুসেন। আমি যখন বড় হলাম, তিনি আমার বিবাহও দিয়েছিলেন, আমার সন্তান ও নাতি আছে। কৃষ্ণ, তাদের সঙ্গেই আমার হৃদয়ের বন্ধন গড়ে উঠেছে।"
অতঃপর কর্ণ তাঁর আরেক সম্পর্কের কথা বলেন—দুর্যোধনের সঙ্গে। তিনি বলেন—
"দুর্যোধনের ওপর নির্ভর করেই আমি ধৃতরাষ্ট্রের বংশে তেরো বছর রাজক্ষমতা ভোগ করেছি। দুর্যোধন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে পাণ্ডবদের সঙ্গে, কারণ সে আমার ওপর ভরসা রাখে।"
এই কারণেই কর্ণ কৃষ্ণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর পালক পিতা-মাতা ও বন্ধু দুর্যোধনের প্রতি ঋণবোধ এতটাই গভীর যে, তিনি রাজত্ব ও জন্মপরিচয়ের সুযোগ পেয়েও তা ত্যাগ করেন।
এটি কর্ণের এক অনন্য মহত্বের পরিচয়—যেখানে তিনি প্রলোভনের চেয়ে কর্তব্য, ঋণ, ও ভালোবাসাকে বেশি মূল্য দেন।
(Karna’s Refusal to Krishna and His Ethical Dilemma)
কর্ণ তাঁর জীবনে গড়ে তোলা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক—দুর্যোধনের সঙ্গে বন্ধুত্ব—বুঝিয়ে বলেন। দুর্যোধন তাঁকে অনেক সম্মান, ক্ষমতা ও ভালোবাসা দিয়েছেন। কর্ণ বলেন—
“তেরো বছর ধরে আমি ধৃতরাষ্ট্রের বংশে অপরিসীম রাজশক্তি উপভোগ করেছি দুর্যোধনের ওপর নির্ভর করে।”
“দুর্যোধন অস্ত্র তুলেছেন ও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছেন পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে, কারণ সে আমার ওপর নির্ভর করে।”
এই সম্পর্কের ঋণেই কর্ণ কৃষ্ণের প্রলোভন-ভরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কর্ণ বলেন—
“গোবিন্দ, আনন্দ বা ভয়, কিংবা সমস্ত পৃথিবী বা সোনার পাহাড়ও আমাকে আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভাঙতে পারবে না।”
তবে কর্ণ বুঝতেন যে দুর্যোধনের ধ্বংস আসন্ন এবং নিজেও তার সঙ্গে মারা যাবেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন—
“পৃথিবী ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে—এর জন্য দায়ী শকুনি, আমি নিজে, দুঃশাসন, এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন।”
“একটি রক্তাক্ত ও ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আসছে, পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে।”
প্রশ্ন: কর্ণ কেন কৃষ্ণের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না?
এখানে কিছু সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে—
1. ঋণ ও কৃতজ্ঞতা: কর্ণ দুর্যোধনের উপকারের কথা ভুলতে পারেন না। তিনি রাজ্য, সম্মান, বন্ধুত্ব সব কিছু দুর্যোধনের কাছ থেকে পেয়েছেন।
2. ধর্ম (Dharma) বনাম বন্ধুত্ব: কর্ণ জানতেন পাণ্ডবরা ধর্মপথে, কৌরবরা অধর্মপথে। তবুও তিনি তাঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চান।
3. আত্মপ্রত্যাখ্যান: কর্ণ হয়তো নিজেকে এতটা পাপী ও অধঃপতিত মনে করেন যে, তিনি redemption-এর যোগ্য নন—তাই তিনি মরেই পাপ মুক্ত হতে চান।
শেষে তিনি কৃষ্ণকে বলেন—
“রাজকুমার, আমরা আবার দেখা করব স্বর্গে, যেখানে আমি নির্দোষ থাকব।”
এই কথায় বোঝা যায়, কর্ণ বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পর তিনি পূণ্যের স্তরে পৌঁছাবেন, যদিও এখন তিনি ভুলপথে আছেন।
কর্ণ কি যুদ্ধ আটকাতে পারতেন?
অবশ্যই। এই পাঠাংশের যুক্তি হলো—
• কৃষ্ণ কেবল কর্ণকে ডেকেছিলেন, কারণ কর্ণ না থাকলে দুর্যোধন যুদ্ধ করার সাহস পেত না।
• কর্ণ যদি পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগ দিতেন, তাহলে যুদ্ধই হত না।
• অতএব, কর্ণের সিদ্ধান্তই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কর্ণ কি জেনে শুনে যুদ্ধকে ঠেলে দিলেন?
হ্যাঁ, লেখক প্রশ্ন তোলেন—
"কর্ণ কি নিজেই যুদ্ধকে সামনে ঠেলে দিচ্ছেন, যেন মৃত্যুতে নিজেকে ও কৌরবদের ধ্বংস করতে পারেন?"
এখানে বোঝানো হয়েছে, কর্ণ হয়তো আরেক ধরণের ধর্ম অনুসরণ করছেন, যেখানে অন্যায়কে ধ্বংস করার জন্য—even নিজের জীবন উৎসর্গ করেও—নিজেকে দায়ী করেন।
কর্ণ যুদ্ধকে কীভাবে ব্যাখ্যা করেন?
তিনি বলেন যুদ্ধ হবে একটি বহ্নিযজ্ঞ (fire sacrifice) এবং কৃষ্ণ হবেন সেই যজ্ঞের আধ্বর্যু পুরোহিত। তিনি বলেন—
“পাণ্ডবদের যেসব অপমান আমি করেছি দুর্যোধনকে খুশি করতে, তা নিয়ে আমি অনুতপ্ত। যখন তুমি আমাকে অর্জুনের হাতে নিহত হতে দেখবে, তখন তা হবে এই যজ্ঞে আগুন জ্বালানোর শেষ পর্ব।”
“যখন ভীম দুঃশাসনের রক্ত পান করবে, তা হবে সোমরসপান।
যখন দ্রোণ ও ভীষ্ম নিহত হবেন, তখন হবে যজ্ঞের সমাপ্তি।
যখন ভীম দুর্যোধনকে হত্যা করবে, তখন হবে যজ্ঞের শেষ।”
এই যজ্ঞ-প্রতিম যুদ্ধচিত্র কর্ণের আত্মোৎসর্গ ও শাস্তি-বোধ প্রকাশ করে।
উপসংহার (Conclusion):
• কর্ণের সিদ্ধান্ত একক মনে হলেও তা পুরো মহাভারতের কাহিনির মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
• কর্ণ নিজের ভুল বুঝেও পেছনে না সরে তাঁর বন্ধুর প্রতি আনুগত্য ও নিজের পাপ মোচনের জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত হন।
• এটাই তাঁকে করে তোলে এক ট্র্যাজিক নায়ক, যিনি নিজের নৈতিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে আত্মবিসর্জনের পথ বেছে নেন।
Comments
Post a Comment